‘স্যার, আপনার নির্দেশেই সব করলাম, কিন্তু ফেঁসে গেলাম আমি’
‘স্যার, আপনার নির্দেশেই সব করলাম, কিন্তু ফেঁসে গেলাম আমি। আপনিতো বলেছিলেন স্যার আপনার আদেশ পালন করতে। সব দেখবেন আপনি। এখন সব আমার উপর চাপিয়ে দিলেন স্যার!’ এভাবেই মিরপুর থানার ওসি সালাউদ্দিনকে কথাগুলো বলছিলেন সুজন হত্যা মামলায় রিমান্ডে থাকা এসআই জাহিদ। ওসি সালাউদ্দিনের কক্ষের এসব কথাগুলো গোপন থাকেনি। মিরপুর থানার চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। কানাঘোঁষা চলছে থানার অভ্যন্তরে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে।
সকল কাজের কাজী হিসেবে পরিচিত বিতর্কিত
ওসি সালাউদ্দিনের অপকর্মের ফিরিস্তি অনেক। ২০১২ সালের ২৯ মে আদালত পাড়ায়
বিচারপ্রার্থী এক তরুণী মোটরসাইকেলে তার বাবার সঙ্গে মুখ্য মহানগর হাকিম
আদালতে যাওয়ার সময় পুলিশের সঙ্গে তার কথা-কাটাকাটি হয়। এরপর পুলিশ তাকে
আদালতপাড়ায় শ্লীলতাহানি করে। এই ঘটনার খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশের
নির্যাতনের শিকার হন কয়েকজন সাংবাদিক ও আইনজীবী। দিনভর ওই তরুণীকে কোতোয়ালি
থানায় আটকে রাখা হয়। পুরো ঘটনার নেতৃত্ব দেন কোতোয়ালি জোনের তখনকার
পুলিশের এসি রাজীব আল মাসুদ ও বিতর্কিত এই ওসি সালাউদ্দিন। পরে খবর পেয়ে
সন্ধ্যায় আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল নিজ
হেফাজতে তরুণীকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। এরপর ওসি সালাউদ্দিনকে প্রত্যাহার করা
হয়েছিলো। কিন্তু বেশিদিন তাকে ক্ষমতার বাইরে থাকতে হয়নি। ডিএমপির আরেক
লোভনীয় থানা মিরপুরে পোষ্টিং পেয়ে যান সালাউদ্দিন।
২০১২ সালের আগস্ট মাসে সালাউদ্দিনকে
মিরপুর মডেল থানার ওসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পরই শুরু হয় সালাউদ্দিনের আরো
নির্মম স্বেচ্ছাচারিতা। শুরুতেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র
আযাহারুল ইসলামকে ধরে নিয়ে থানায় আটকে রেখে হাত-পা ভেঙে দেয়। হাত-পায়ের নখ
তুলে নেয় পুলিশ। এরপর ২ লাখ টাকা দাবি করে। আযাহার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ছিলেন। পরে কয়েকদিন তাকে খুঁজে না
পাওয়ায় পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন পরিবারের সদস্যরা। এরপর তাকে
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে গিয়ে তার পরিবারের
সদস্যরা জানতে পারেন, ওসি সালাউদ্দিনের নির্দেশেই এ কাজ করা হয়।
গত বছরের ১৭ মার্চ মিরপুরে মাহবুব বাবলু
নামের এক যুবকের পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে পুলিশ। ওই ব্যক্তি এখন পঙ্গু।
গত বছরের ১০ এপ্রিল রাত ৯টার দিকে রাজধানীর মিরপুর থানার কাজীপাড়া এলাকা
থেকে মিল্টন ও শিপন নামে দুই যুবদল কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। থানায় নেওয়ার
আধা ঘণ্টা পরে তাদের আহত অবস্থায় পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাদের হাত-পায়ে
গুলি করে পঙ্গু করে দেওয়া হয়। এছাড়াও আরো অনেকেই ওসি সালাউদ্দিনের
নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বহু পরিবারকে গুনতে হয়েছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।
ওসি সালাউদ্দিনের দাপটের কাছে অসহায়
তদন্তকারীরা। অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও সালাউদ্দিনের নাম শুনলেই চুপসে যান।
পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, পুলিশ বাহিনীতে ওসি সালাউদ্দিনের একটি
সিন্ডিকেট রয়েছে। ওই সিন্ডিকেটের ছত্রচ্ছায়ায় তিনি দাপটের সঙ্গে ডিএমপিতে
নানা অপকর্ম করে আসছেন। ওসি সালাউদ্দিনের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায়। যার
বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন, অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, নিরপরাধ
মানুষকে রাজনৈতিক লেবেল লাগিয়ে বছরের পর বছর হয়রানি এবং চেইন অব কমান্ড
ভঙ্গসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষক, ছাত্র, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ,
সাংবাদিকসহ কেউই বাদ যাননি ওসি সালাউদ্দিনের নির্যাতন থেকে।
অভিযোগ ওঠেছে, ওসি সালাউদ্দিনের নির্দেশেই
এসআই জাহিদ মিরপুর এলাকায় চাঁদাবাজি করে বেড়িয়েছেন। ওই চাঁদার একটা মোটা
অঙ্ক ওসিকে ভাগ দিতে হয়েছে। সুজন হত্যার দিন ওসি সবকিছু জেনেও চুপ ছিলেন।
ইচ্ছা করলেই সুজনকে বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।
সুজন হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে এখন বিপাকে
পড়েছেন তার পরিবারের সদস্যরাও। রোববার যখন আদালত নিহত সুজনের স্ত্রীর দায়ের
করা মামলাটি আমলে নিয়ে বিচারিক তদন্তের আদেশ দেন, তখন একই সঙ্গে
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তার পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে বলেন আদালত। লুচি
অভিযোগ করেন, মিরপুর থানায় যখন নির্যাতনে সুজনের মৃত্যু হয় তখন এ ঘটনাকে
ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য ওসি সালাউদ্দিন অনেককে থানাহাজতে সুজনের
হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর খবর দেন। এ ছাড়া, সালাউদ্দিনের নির্দেশেই ব্যবসায়ী
সুজনকে এসআই জাহিদ ধরে নিয়ে যায়। যা গ্রেফতারের পর আদালত চত্বরে তিনি
সাংবাদিকদের বলেছেন। যা কিছু করেছেন সবকিছুই ওসির নির্দেশে করেছেন। সুজনের
স্ত্রী লুচি আরো অভিযোগ করেন, সবকিছুই ওসি সালাউদ্দিন জানতেন। সকালে তার
নির্দেশেই সুজনের স্ত্রী এবং শিশুসন্তানকে থানা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
সালাউদ্দিন কোনোভাবেই এই হত্যার দায় এড়াতে পারবেন না। মিরপুর জোনের ডিসির
কাছেও পরিবারের পক্ষ থেকে সুজনকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল।
No comments:
Post a Comment