জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের ‘সেলফ ডিফেন্স’
অন্যের ভূখণ্ড দখল এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠিকে উৎখাত ও বিতাড়িত করে
সাম্রাজ্যবাদী যুগে যে 'সেটলার কলোনিয়াল' রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে জায়নবাদী
রাষ্ট্র ইসরায়েল সেই ধরণের একটি রাষ্ট্র। রুজভেল্ট ও চার্চিলের আটলান্টিক
চার্টার অনুযায়ী এই ধরণের রাষ্ট্রের 'সেলফ ডিফেন্স' দূরের কথা অস্তিত্বের
বৈধতা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী থাকবার কথা নয়। অথচ জায়নবাদের পক্ষে
গণমাধ্যম সেলফ ডিফেন্সের শঠতাসর্বস্ব যুক্তি ফেরি করে বেড়াচ্ছে, প্রাণ
দিচ্ছে গাজার মানুষ।
সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনের সম্পর্ক যে 'সোনার পিতলা কলস'
জাতীয় ব্যাপার সেটাই এই নিবন্ধে আলোচিত হয়েছে। ফিলিস্তিনীদের ভূখণ্ড দখল
করে, তাদের বাড়ীঘর থেকে উৎখাত করে সেখানে জায়নিস্টদের বসতি স্থাপন নিশ্চিত
করতে গিয়ে গাজায় কার্যত কারাগারে আটকে রাখা ফিলিস্তিনীদের হত্যা কিসের
'সেলফ ডিফেন্স? ডাকাত গৃহস্থের বাড়ীঘর লুট করতে গেলে গৃহস্থ বাধা দিলে তাকে
হত্যা করছে, আর সেই হত্যাকাণ্ডকে সে দাবি করছে ‘সেলফ ডিফেন্স’। লুটেরা
ডাকাতের আত্মরক্ষা? কাণ্ডজ্ঞান তো বটেই, এমনকি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এই
অধিকার একমাত্র ফিলিস্তিনীদের থাকবার কথা। যদি ইসরায়েলের থাকে তার হাজারগুণ
থাকবার কথা ফিলিস্তিনীদের। অথচ সেলফ ডিফেন্সের অধিকার ফিলিস্তিনীদের নাই,
আছে নাকি শুধু জায়নিস্টদের।
জায়নিস্ট ইসরায়েলের হাতে গাজায় ফিলিস্তিনিদের হত্যার উৎসব চলছে। আর এ
হত্যাযজ্ঞের পক্ষে ছদ্ম-ন্যায্যতার বয়ান এটাই। ইসরায়েল নাকি নিজের ‘সেলফ
ডিফেন্স’ বা নিজেকে রক্ষা করবার জন্য এটা করছে। সুতরাং এটা জায়েজ। ইসরায়েল
রাষ্ট্রের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমেরিকা, ব্রিটেনসহ ইউরোপের অন্যান্য শক্তিধর
রাষ্ট্রের বয়ান হলো, তারা ইসরায়েলের সেলফ ডিফেন্স বা আত্ম রক্ষার অধিকার
সমর্থন করে। এই দাবি শুনলে মনে হয় এটা খুব র্যাসশনাল বা যুক্তিযুক্ত কথা।
আমরাও ভাবি, পাশ্চাত্য বুঝি বুদ্ধির যুক্তি ছাড়া কথা বলে না। এই অনুমান যে
কতোটা মিথ্যা সেটা ‘সেলফ ডিফেন্স’-এর নামে চরম শঠতা ও চাপাবাজি পরীক্ষা
করলেই বোঝা যায়।
তো তাদের সেলফ ডিফেন্সের শঠতা ও চাপাবাজি যদি মানি, তাহলে
ফিলিস্তিনিদেরও সেলফ ডিফেন্সের অধিকার থাকার কথা। তা-ই না? অন্তত
জায়নিস্টদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হওয়ার কথা। কারণ ইসরায়েল এমন এক রাষ্ট্র, যে
অন্যের ভূখণ্ড, অন্যের জোত জ- বাড়িঘর দখল করে ব্যবহার করছে। আবার, এ এক
অদ্ভূত ও বিচিত্র রাষ্ট্র যার রাষ্ট্রীয় সীমানা প্রতিদিন বাড়ে।
জাতিসংঘের আইন অনুযায়ী “দখলদারের” বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-আত্মরক্ষার লড়াই বা
সেলফ ডিফেন্স -- বৈধ ও স্বীকৃত। নিজেদের রক্ষার জন্য ফিলিস্তিনিদের সেলফ
ডিফেন্স প্রতিরোধ সবই অতএব আন্তর্জাতিক আইনে বৈধ ও স্বীকৃত। দ্বিতীয়ত:
নিজেকে রক্ষা বা সেলফ ডিফেন্সের জন্য পাথর ছুড়ে মারা, গুলতি মারা, হাতে
তৈরি রকেটসহ যা কিছু ফিলিস্তিনিরা ব্যবহার করছে সবই বৈধ ও স্বীকৃত। কিন্তু
হাওয়াই কথাবার্তা না বলে ব্যাপারটাকে আনর্জাতিক আইনের দিক থেকে বোঝা জরুরী।
এই আইন ও স্বীকৃতি কবেকার? কোথা থেকে এল? আর কেনই বা সাম্রাজ্যবাদ তার
তোয়াক্কা না করে উল্টা জায়নবাদী রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়ায় সেটা বোঝা দরকার।
নইলে ফিলিস্তিনী জনগণের সশস্ত্র প্রতিরোধের ঐতিহাসিক তাৎপর্য না বোঝার
কারনে অহিংসা, শান্তি, মানবতাবাদ ইত্যাদির আড়ালে জ্ঞানে বা অজ্ঞানে
জায়নবাদের পক্ষেই দাঁড়াব।
রুজভেল্ট ও চার্চিলের আটলান্টিক চার্টার ১৯৪১
তো শুরু করতে পারি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে স্মরণ করে। রুজভেল্ট
পরপর চারবার (১৯৩৩ -৪৫) আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ব্রিটিশ
প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে নাকে খত দিয়ে স্বীকার করিয়ে নেয়ার মাধ্যমে যে
বিষয়গুলোকে আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিলেন সেই দলিল পড়ে দেখা
যাক। সেই দলিল হোল নিউফাউন্ডলেন্ডে ৪ অগাস্ট ১৯৪১ সালে স্বাক্ষরিত
আটলান্টিক চার্টার ১৯৪১। না আমি এতটুকুও বাড়িয়ে বলছি না, এটা নাকে খত দিয়েই
কবুল করিয়ে নেয়া দলিল। ‘হিজ ম্যাজেস্টিস ব্রিটেন’ বা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য
তখনও দুনিয়ার সবচেয়ে বড় রুস্তম। মহা কলো্নিয়াল মাস্টার; , আমরাও তখন কলোনির
অধীন। ইংরেজ আমাদের রাজা। অথচ ওই আটলান্টিক চার্টারে চার্চিল স্বীকার করতে
বাধ্য হয়েছিলেন যে কোন দেশকে কলোনি বানানো যাবে না, কলোনি বানিয়ে দখল করে
রাখা যাবে না। কলোনি দখল বা কলোনিয়ালিজম খুবই খারাপ, অন্যায্য ও খতরনাক
জিনিস। সাম্রাজ্যবাদী মহাপ্রভূ হিসাবে এটা ব্রিটেনের নেতিয়ে পড়ার আরম্ভ,
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্থানের শুরু।
আটলান্টিক চার্টার ছিল ছিল মূলত আমেরিকা ও ব্রিটেনের এক যৌথ ঘোষণা।
ওখানে আটটা দফা আছে, যার প্রায় সবই কলোনি দখল ও ঔপনিবেশিক কায়দায় সাম্রাজ্য
বিস্তার সংক্রান্ত, যদিও কলোনি বা এম্পায়ার শব্দ উচ্চারণ না করেই
চার্টারটি লেখা হয়েছে। প্রথম দফা বলছে, আমেরিকা ও ব্রিটেন নিজেদের বৃহৎ বা
আরও ভূখণ্ড দখল করে সম্প্রসারিত হবার বাসনা রাখে না। তাদের দেশ ভৌগলিক বা
অন্য কোন প্রকার বিস্তার ঘটাক এটা আর তাদের কামনা নয়। অর্থাৎ প্রথম
চুক্তিতেই ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের বিস্তার আর না চাইবার কথাই বলা হোল।
দ্বিতীয় দফা বলছে, ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনে এখন যেসকল ভূখণ্ড রয়েছে
তার কোন পরিবর্তন বা অদল বদল ঘটুক সেটা তারা চায় না। ইংরেজের অধীনে যে
দেশগুলো আছে সেগুলো থাকবে। তবে সেই সকল জায়গার বাসিন্দারা নিজেরা মুক্ত ও
স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যদি স্বাধীন হবার ইচ্ছা ব্যক্ত করে তবে দখলে রাখা
ভূখণ্ডের পরিবর্তন (territorial change) হতে পারে। সোজা কথা পরাধীন দেশগুলো
কোন প্রকার বাইরের চাপ ছাড়া মুক্ত ও স্বাধীন হতে চাইলে সে অধিকার তাদের
থাকবে। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যর অধীন হতে না চাইলে তারা আলাদা হতে পারবে। এতে
একদিকে উপনিবেশ থেকে জনগণের মুক্তির অধিকার মেনে নেওয়া হোল, অন্যদিকে
ঔপনিবেশিক ইংরেজকে আশ্বস্ত করা হোল ঔপনিবেশিক দেশের জনগণ না চাইলে
ঔপনিবেশিকতার শৃংখল থেকে মুক্তির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের কোন
উসকানি দেবে না। কিন্তু মূলকথা, কলোনিদখল বন্ধ করতে হবে, এটা আর নয়। এছাড়া
যেগুলো কলোনি হয়ে আছে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাদের কলোনি মুক্ত করতে
হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন যে কোন ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের নিজ
পছন্দের সরকার বেছে নেয়ার অধিকারকে সম্মান করে। এটা বলা হয়েছে তৃতীয় দফায়।
যেসকল দেশে জনগণের এই সার্বভৌম অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে ও তাদের নিজেদের গঠিত
সরকারকে জোর করে ঔপনিবেশিক শক্তি উৎখাত করেছে তা প্রশমনের প্রস্তাব আছে এই
দফায়। বলা হয়েছে সার্বভৌমত্ব হারা জনগণের সার্বভৌমত্ব ও সরকার গঠনের
কর্তৃত্ব যেন তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এখানে ইংরেজের ঔপনিবেশিক শক্তি খর্ব
করে দেবার কথাই বলা হয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্থানের আগে গ্রেট
ব্রিটেন ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে বড় রুস্তম – সবচেয়ে বড় কলোনিয়াল মাস্টার। ।
দুনিয়ার সেই সময়ের মহা শক্তিধর রুস্তমকে দিয়ে এসব স্বীকার করিয়ে নেয়া নাকে
খত দেয়া ছাড়া আর কি! আগ্রহীরা পুরা আটলান্টিক চার্টার ১৯৪১ দেখে নিতে পারেন
এখানে।
বাঘ তো মাংসই খায়, বাঘ ঘাস খায় না। কিন্তু কখন ও কি পরিস্থিতিতে বাঘ ঘাস
খেতে বাধ্য হয় সেটা বোঝা দরকার। রুজভেল্ট চার্চিলকে কি পরিস্থিতিতে এই
চার্টার নাকে খত দিয়েই মানতে ও স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছি্লেন, সেটা আরেক
ইতিহাস। আপাতত দু-একটা বাক্য খরচ করব কেবল।
১৯৩৯ সালে -- অর্থাৎ আটলান্টিক চুক্তির দেড়-দুই বছর আগে দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, হিটলারের জার্মানি ফ্রান্স দখল ইতোমধ্যে শেষ
করেছে;এবার ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে দাঁড়িয়ে হিটলার তখন ব্রিটেন দখলের বুদ্ধি
আঁটছিল। তাই চার্চিল এসেছেন রুজভেল্টের কাছে ভিক্ষা মাঙতে যেন তিনি পক্ষ
নেন, পাশে দাঁড়ান। ব্রিটিশ এম্পায়ারের সুবিস্তৃত কলোনি যায় যাক,কিন্তু খোদ
নিজ ভূখণ্ডটা যদি রক্ষা করা যায়, সেটাই ছিল মামলা। । আর রুজভেল্টের দিক
থেকে উঠতি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর আগামী
দুনিয়াটা দেখতে কেমন হবে সেই দেখার স্বপ্নের দলিল ছিল আটলান্টা চার্টার।
তার সেই স্বপ্নে সায় দেয়ার বিনিময়ের শর্তেই রুজভেল্ট ইউরোপ উদ্ধারে রাজি
হয়েছিলেন। তাই আটলান্টা চার্টার উঠতি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে ইউরোপের
কলনিয়াল মাস্টারদের দাসখতের দলিল। পরের বছর ১৯৪২ সালের পয়লা তারিখে এই
আটলান্টিক চার্টারকেই ভিত্তি মেনে জাতিসংঘ গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। এই
জাতিসংঘের কাজ কী হবে, সেসবের বিস্তারিত জাতিসংঘ চার্টার নামে খ্যাত।
জাতিসংঘ পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় ১৯৪৫ সালে। সেলফ ডিফেন্স, রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ড,
সার্বভৌমত্ব, আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার ইত্যাদির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়ার
প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে জাতিসংঘ ও এর চার্টার।
উপনিবেশ ও ঔপনিবেশিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা যে-দুনিয়া তখন বিদ্যমান
ছিল রুজভেল্টের চোখে সেটা ছিল হারাম। একটি বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা
গড়ে উঠতে চাইছে,অভিমুখ তৈরি হয়েছে। আর সেই গড়ে ওঠার পথে ঔপনিবেশিক শক্তি ও
সম্পর্ক একটা বাধা। তিনি এক গ্লোবাল ক্যালিটালিজমের স্বপ্ন দেখছিলেন, ওয়াল
ষ্ট্রিটের চোখে দেখা সেই স্বপ্নে দুনিয়াটা পুঁজির বিনিয়োগ ও মুনাফা তুলে
আনার বাজার। সরাসরি বা প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিকক শোষণ লুন্ঠনের চেয়েও
পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে মুনাফা অর্জনের সুবিধা তখন স্পষ্ট হয়ে
উঠেছে। একটি দেশকে রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন ও তার তার সার্বভৌমত্ব স্বীকার
করে নেবার পরেও সম্পদের পুঞ্জিভবন ও স্ফীতি ঘটানো যায় তাহলে সেটাই তো
অগ্রসর সম্পর্ক। রূজভেল্ট ইতিহাসের এদিকটাই দেখতে পেয়েছিলেন। তবে অগ্রসর
সম্পর্কের দিকটা দেখতে পেলেই এর পক্ষে দাঁড়িয়ে যেতে হবে এমন কোন “ঈমানি”
কারণ সেখানে ছিল না। ছিল নিজেকে আগামি দুনিয়ার এম্পায়ার বা সাম্রাজ্যবাদ
হিসাবে দেখতে পাবার দ্বপ্ন, চাঁচাছোলা বৈষয়িক স্বার্থ।
কাজেই নিজের ‘সেলফ ডিফেন্স’এর নামে গাজায় ইসরায়েলে রক্তের নদী বইয়ে
দেবার কোন বৈধ আন্তর্জাতিক অধিকার নাই। বরং ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারই
এখানে ভূলুন্ঠিত। আটলান্টিক চার্টার অনুযায়ী হামলার মুখে ইসরাইলকে পাল্টা
হামলা ও ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে লড়বার বৈধ অধিকার ফিলিস্তিনীদের রয়েছে।
আর তাকে পরাশক্তিগুলো আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সমর্থন করবার কথা। এই অধিকার
সম্পর্কে গণমাধ্যমের চুপ থাকা, কোন উচ্চবাচ্য না করা জায়নিজমের সঙ্গে
গণমাধ্যমের ঘনিষ্ট সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়।
প্রশ্ন যে ফিলিস্তিনীদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে বৈধ হলেও
সে সম্পর্কে নিরব থাকা এবং অস্বীকার করা হচ্ছে কেন? একে এতো উৎকট ভাবে
লংঘনেরও বা কারন কি? আটলান্টিক চার্টার বা আন্তর্জাতিক আইনে কি আছে সেটা
আমাদের জানা দরকার কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন লংঘনের ব্যাখা আইনী জায়গা থেকে
করা যাবে না। আন্তর্জাতিক আইনে বা আটলান্টিক চার্টার বোঝাটা এই ক্ষেত্রে
যথেষ্ট নয়। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো তাদেরই তৈয়ারি আইন নিজেরাই নিজেদের
সুবিধা মতো ভঙ্গ করে। গাজার গণহত্যার ক্ষেত্রে আমরা দেখছি ফিলিস্তিনীদের
আত্মরক্ষার অধিকার সম্পর্কে নীরব থেকে কেবল জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের
‘সেলফ ডিফেন্স’-এর কথাই তারস্বরে প্রচার করা হচ্ছে। এই চরম হিপোক্রাসি বা
শঠতার দিকটা উন্মোচন করবার জন্যই আন্তর্জাতিক আইনে ফিলিস্তিনী লড়াই ‘বৈধ’
এবং ইস্রাইলের হামলা অবৈধ এটা আমামদের বুঝতে হবে। বারাক ওবামাসহ
সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর নেতারা যতোই ইস্রায়েলের পক্ষে ‘আত্মরক্ষার’ কথা
বলুক, ততোবারই বুঝতে হবে, এটা মিথ্যা। এই দাবির কোন আইনী ভিত্তি নাই। নৈতিক
ভিত্তিও নাই। এই পরিস্থিতিতে সশস্ত্র যুদ্ধ ছাড়া নিপীড়িত জনগোষ্ঠির সামনে
কোন আইনী রাস্তা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো খোলা রাখে না। সাম্রাজ্যবাদ আইন
বা বৈধতার তোয়াক্কা করে না। এই দিক না বুঝলে কেন ফিলিস্তিনীদের সশস্ত্র
সংগ্রামের বাস্তব কারন আমরা বুঝবো না। এটা অনুধাবন করতে পারেন না বলে অনেকে
মানবতাবাদী ও অহিংস অবস্থান গ্রহণ করেন, নিজেদের ভালোমানুষী প্রকাশ করতে
গিয়ে মূলত জায়নবাদীর পক্ষাবলম্বন করেন। সশস্ত্র সংরাম ছাড়া ফিলিস্তিনীদের
সামনে আর কোন পথ খোলা নাই।
ফিলিলিস্তিনীদের আত্মরক্ষা ও সশস্ত্র প্রতিরোধের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের
কথা বাদ দিয়ে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের কথা বলার অর্থ জায়নবাদের
পক্ষাবলম্বন – এটা আমাদের বুঝতে হবে। আন্তর্জাতিক আইনের বৈধতা ও অবৈধতার
তর্কের বাইরে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে জায়নবাদের সম্পর্ক বোঝার এটা প্রাথমিক
পদক্ষেপ। ইসরাইলের সেলফ ডিফেন্সের অধিকার আছে এই কথা বলে জায়নবাদী
রাষ্ট্রের পক্ষে পশ্চিমের র্যা শনাল বুদ্ধির প্রপাগাণ্ডা সর্বার্থে
জায়নবাদী প্রপাগাণ্ডা। আটলান্টিক চার্টার অনুযায়ী কলোনিয়ালিজম বা ‘সেটলার
কলোনিয়ালিজম’-এর কোন বৈধতা নাই। অতএব ইসরায়েলের টিকে থাকারই বৈধতা নাই।
সেলফ ডিফেন্স তো দূরের কথা। ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড দখল করে ফিলিস্তিনীদের
বাড়ীঘর থেকে উচ্ছেদ ও দেশছাড়া করে সেটলার কলোনিয়ালিস্ট রাষ্ট্রে সেলফ
ডিফেন্স আন্তর্জাতিক আইন বা নীতিনৈতিকতা কোন দিক থেকেই টেঁকে না। দখলদারদের
সেলফ ডিফেন্স সে কারনে একশ ভাগ মিথ্যা ও হিপোক্রেসি ছাড়া আর কিছুই হতে
পারে না। অথচ দিনের পর দিন এই কপট ও শঠ যুক্তি আমাদের শুনতে হচ্ছে।
ফিলিস্তিনিদের ভূমি জায়নিস্টদের জবরদখল
ফিলিস্তিনিদের দুঃখের শুরু শুধু না, তাদের সামনে রেখে সারা দুনিয়াকে
বে-ইনসাফি, অনাচার, অত্যাচা্র, হত্যা ও নিপীড়নের দুনিয়া বানানোর কারবারের
শুরু বলা যেতে পারে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন থেকে। উপনিবেশলোভী ব্রিটিশের
বাসনা ছিল ভূমধ্যসাগর দিয়ে মিসর-ফিলিস্তিন হয়ে আগেই দখল হয়ে থাকা
ব্রিটিশ-ভারত পর্যন্ত পুরা ভূগোলটাই হবে তাদের কলোনি। ভূখণ্ডগতভাবে পুরাটা
জুড়েই নিজের উপনিবেশ বিস্তার করবে তারা। ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান
সাম্রাজ্যের খলিফা ব্রিটিশ ও ফরাসি আক্রমণের মুখে সারা দুনিয়ার প্রতি যে
আহ্বান রেখেছিলেন, তা আংশিক হলেও আজ সত্যি হয়েছে। খেলাফত আন্দোলনের সূচনা
এখান থেকেই। মিসর, ফিলিস্তিনসহ সারা মধ্যপ্রাচ্য ১৯১৮ সালের আগে ছিল অটোমান
সাম্রাজ্যের অধীন। সাম্রাজ্য রক্ষার প্রতিযোগিতায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছিল
তার প্রধান প্রতিযোগী ও শত্রু। ওদিকে দেরিতে উদীয়মান জার্মান ছিল তাই
টেকনোলজি ও ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে ্তুরস্কের অটোমানদের ইউরোপীয় পার্টনার। সেই
সূত্রে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (আগস্ট ১৯১৪-নভেম্বর ১৯১৮) পক্ষ-বিপক্ষ ভাগের
দিক থেকে তুরস্ক ছিল জার্মানির পক্ষে। অর্থাৎ ব্রিটিশ ও ফরাসিদের বিপক্ষে।
সে যুদ্ধে জার্মানির সঙ্গে অটোমান তুরস্কেরও পতন হয়। যুদ্ধ শেষে অটোমান
সাম্রাজ্যের এলাকাগুলো ভাগ করে নেয় ব্রিটিশ ও ফরাসিরা। এই হলো মোটাদাগে
ইতিহাসের ঘটনা।
ব্রিটিশ ও ফরাসি দুই কূটনীতিকের (Sir Mark Sykes এবং Georges Picot)
স্বাক্ষরিত ভাগবাটোয়ার গোপন চুক্তির নাম Sykes-Picot Agreement of 1916
অর্থাৎ চলমান যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ১৯১৬ সালে এই চুক্তি হয়েছিল। এ চুক্তি
অনুসারে একদিকে বাগদাদকে রাজধানী করে উত্তরে মসুল আর দক্ষিণে বসরা এ তিন
অঞ্চল নিয়ে নতুন রাষ্ট্র ইরাকের জন্ম দেয় ব্রিটিশরা, সঙ্গে ভূমধ্যসাগরের
তীরের মিসর ও ফিলিস্তিনকে নিজের ভাগে নেয়। অন্যদিকে এ দুয়ের মাঝখানে
লেভান্ট অংশ দেয়া হয় ফরাসিদের। Levant ইতালি-ফরাসি উৎসের এ শব্দের আক্ষরিক
অর্থ ইংরেজিতে রাইজিং অর্থাৎ উদিত হওয়া, মানে যেখানে সূর্য সবার আগে ওঠে।
একসময় ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরের গ্রিস থেকে মিসর পর্যন্ত সব দেশকেই এক
শব্দে ‘লেভান্ট’ অঞ্চল বলা হত। ভুমধ্যসাগরের পুর্ব তীরের এলাকা হওয়ায়
দেশগুলোতে আগে সুর্য উঠে বলে এই নামের উৎপত্তি। কালক্রমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে
অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর তার শাসিত সিরিয়া ও লেবানন এবং আজকের
ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল উভয়ের কিছু অংশ মিলে মোট ভূখণ্ডকে লেভান্ট অঞ্চল নামে
ডাকা হোত – যে অঞ্চল ভাগবঁটোয়ারার চুক্তি অনুযায়ী ফরাসিদের দিয়ে দেয়া হয়।
প্রসঙ্গ ক্রমে বলে রাখি, চলমান ইরাকে ইসালামি খেলাফত বা খলিফা রাষ্ট্র
ঘোষণার সময়ে ISIL শব্দের অর্থ ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভেন্ট।
অর্থাৎ যারা ব্রিটিশ-ফরাসিদের ইরাক ও লেভেন্ট বলে কলোনি ভাগবাঁটোয়ারা
মানেনা। এই হল লেভান্ট নামের তাতপর্য।
তবে অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন অঞ্চলকে ব্রিটিশ-ফরাসিরা ভাগ করে নিলেও এর
আইনি কাগজপত্রের আনুষ্ঠানিকতায় একটা রাখঢাক ছিল। বলা হয়, ‘লীগ অব
নেশানস’-এর কাছ থেকে ব্রিটিশ-ফরাসিরা এ অঞ্চলগুলোয় ‘ম্যান্ডেট’ হিসেবে শাসন
করবার অধিকার পেয়েছিল। লীগ অব নেশন হলো জাতিসংঘের আগের রূপ ও ভার্সন। এটা
গঠিত হয় ১৯২০ সালে, কিন্তু শুরুর দশ বছরের মধ্যে কার্যত অকেজো হয়ে পড়ে। ওর
এক সদস্য ইটালি অন্য সদস্য দেশের কলোনি ইথিওপিয়াকে দখল করে নেয়ার বিরুদ্ধে
বাকি সকল সদস্য মিলে ন্যূনপক্ষে নিন্দা করতে না পারে নাই। এ ধরনের ঘটনা
থেকে লিগ অব নেশানস অকার্যকর পড়েছিল ১৯৪১ সালে আটলান্টা চুক্তি স্বাক্ষরের
আগ পর্যন্ত। এরপর লিগ অব নেশনের পুনরুজ্জীবন ঘটে নতুন নামে, নতুন চুক্তি
অনুযায়ী। ১৯৪২ সালের পয়লা জানুয়ারির এক ঘোষণায় এর নাম হয় জাতিসংঘ।
তাহলে এটা মনে রাখা দরকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের তিনশ বছর কেটেছে
ব্রিটিশ, ফরাসি ও অন্যান্য ঔপনিবেশিক শক্তির নিজ নিজ সাম্রাজ্য বিস্তারের
জন্য কলোনির পর কলোনি দখল করার মধ্য দিয়ে। অথচ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী
হওয়ার পর এবার যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ আদায়ের উছিলার যুক্তি তুলে জার্মানির কাছ
থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা করে তারা আর অটোমান সাম্রাজ্যকে ভাগ করে
নেয়। ওই ক্ষতিপূরণ আদায় এবং অটোমান সাম্রাজ্যের নতুন ভাগবন্দোবস্ত দেয়ার ও
তদারকির আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯২০ সালে লিগ অব নেশন গঠিত হয়েছিল।
ম্যান্ডেট কথাটার মানে কাগজপত্র অনুযায়ী অটোমান সাম্রাজ্যের রাজ্যগুলো লীগ
অব নেশানের ‘ট্রাস্টি পরিষদ’ নামের এক বিভাগের হাতে হাওলা করে দেওয়া। এরপর
ট্রাস্টি পরিষদ ওর নতুন বিলি বন্দোবস্ত দিল ব্রিটিশ ও ফরাসিদের। এ নতুন
বিলিবন্দোবস্তের আইনি নামই ‘ম্যান্ডেট’। লীগ অব নেশন গঠনের আর্টিকেল ২২,
এটা ম্যান্ডেট সংক্রান্ত আর্টিকেল।
No comments:
Post a Comment