Friday, 25 July 2014

কর্ণেল তাহের এবং ভুল সময়


কর্ণেল তাহের এবং ভুল সময়

 



মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়, নিয়মিত ব্রিগেড বানানোর উপর জোর না দিয়ে রেগুলার গেরিলা যুদ্ধের উপর গুরত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করেন সদ্য পাকিস্তান ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা মেজর তাহের। সেনাপ্রধাণ ওসমানীসহ অন্যান্য সেক্টর কমান্ডাররা প্রস্তাবে অনাস্থা প্রকাশ করলেও সমর্থন দেন জেড ফোর্সের প্রধান মেজর জিয়া। সেদিন থেকে দুজন মানুষের ইতিহাসে এক সরল রেখায় অবস্থানের সূচণা। জিয়ার সমর্থনে কৃতজ্ঞতাবোধ করেছেন, নিজের চিন্তার সঙ্গে মিলে যায় ধরে নিয়েছেন। ১১ নং সেক্টরের দায়িত্বে থেকে মেজর জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন জেড ফোর্সের সদর দপ্তরে যেয়ে। ৩১ জুলাই জিয়ার জেড ফোর্সের নেতৃত্বে কামালপুর আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা, ৬৭ জন জন মুক্তিযোদ্ধা সেখানে শহীদ হন। মিসটাইমিং এবং ভুল কমান্ডের কারনে সাপোর্টিং ইন্ডিয়ান আর্টিলারির গোলা নিজেদের উপরেই পড়ে। এ ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হয়ে মেজর জিয়ার কোর্ট মার্শাল করার চিন্তাও করেছিলেন ওসমানী। পরবর্তীতে মেজর তাহের এই কামালপুর অপারেশনে মর্টারের আঘাতে পা হারান। পঙ্গুত্ব বরণ করেন।
৩রা নভেম্বর ১৯৭৫, রক্তপাতহীন যে অভ্যুত্থান জেনারেল খালেদ মোশাররফ শুরু করেন তার প্রথমেই সেনা প্রধান জিয়াকে গৃহবন্দী করা হয় (বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মোস্তাক সরকার জিয়াকে সেনাপ্রধাণ নিয়োগ দেন)। ৪৬ ব্রিগেডের ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ জিয়ার ড্রয়িংরুমের টেলিফোন লাইনটি বিচ্ছিন্ন করলেও বেডরুমের টেলিফোন লাইন সচল ছিল (এটা নিয়ে মতবিরোধ আছে) এবং ধারণা করা হয় এই ফোনেই জিয়া তাহেরের কাছে তার প্রাণ বাঁচানোর জন্য যোগাযোগ করেন। তাহের তখন সেনাবাহিনী থেকে অবসরে গেছেন এবং বাংলাদেশের নদী বিষয়ক সরকারী সংস্থার প্রধানের দায়িত্বে আছেন নারায়নগঞ্জে। কিছুটা আড়ালে থেকেই জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার প্রধানের দায়িত্বেও আছেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী তাহেরের নির্দেশে হাবিলদার হাই এর নেতৃত্বে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যারা জিয়াকে ৬ নভেম্বর দিবাগত রাতে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়ে আসতে থাকলে সামনে গোলাগুলির আওয়াজে গাড়ি থামাতে হয়। ১৫ই আগস্টের কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া মেজর মহিউদ্দিন এসে তখন জিয়াকে তার টু ফিল্ড আর্টিলারির হেডকোয়ার্টারে নিয়ে বসান এবং ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যাওয়া নিরাপদ নয় বলে মত দেন। এবং ঘটনাড় টুইস্ট এখানেই। (১৫ই আগস্টের কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া মেজরদের ৪ নভেম্বর বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হলেও কোনভাবে পালিয়ে থেকে যায় মেজর মহিউদ্দিন) পরবর্তীতে তাহের এসে জিয়ার সাথে কথাবার্তা বললেও পূর্বশর্ত অনুযায়ী ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। এতক্ষণ তাহেরের হাতে কন্ট্রোল থাকলেও পরবর্তীতে তা জিয়ার হাতে চলে যায় এবং মুক্ত জিয়া এবং আস্তে আস্তে সৈনিকদের দাবী দাওয়াগুলো উড়িয়ে দিতে থাকেন। ওসমানী,জিয়া এবং উচ্চপদস্থ সেনা প্রধানদের মিটিংএ সিদ্ধান্ত হয় খালেদ মোশাররফ কর্তৃক উচ্ছেদ হওয়া মোস্তাক সরকারকে আবার ক্ষমতায় বসানোর। বাতিল হয় ক্ষুদ্ধ তাহেরের ভেটোতে। বিচারপতি সায়েমকে রাস্ট্রপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে জেনারেল জিয়া জাসদ নিধনের নামে শত শত নেতা কর্মীর সাথে তাহেরকেও গ্রেপ্তার করে। শুরু হয় গোপন বিচার। মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা এই ট্রাইব্যুনালের প্রধান হতে অপারগতা প্রকাশ করলে পাকিস্তান ফেরৎ কর্ণেল ইউসুফকে প্রধান কর হয়। কর্ণেল তাহের প্রধান আসামী এবং হাবিলদার হাইকেও এই ট্রাইব্যুনালে বিচার করা হয়। তাহের সহ অন্য সবাইকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিলেও তাহেরকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।
পরিবারের সদস্যরা রাস্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে অনুরোধ করলেও তাহের অস্বীকৃতি জানায়। যাকে তিনিই রাস্ট্রপতি বানিয়েছিলেন তার কাছে ক্ষমা চান নি তাহের। ২১ জুলাই রাত ৪:০১ মিনিটে ফাঁসী হয় তাহের। ফাঁসীর আগে মঞ্চে দাঁড়িয়ে পাঠ করেন সহযোদ্ধা মেজর জিয়াউদ্দিনের কবিতা-
জন্মেছি সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে
কাঁপিয়েই গেলাম
জন্মেছি তাদের বুকে পদচিহ্ন আঁকব বলে
এঁকেই গেলাম।
জন্মেছি মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে
করেই গেলাম।
জন্ম আর মৃত্যুর দুটো বিশাল পাথর
রেখে গেলাম।
সেই পাথরের নীচে শোষক আর শাষকের
কবর দিলাম।
পৃথিবী অবশেষে এবারের মত বিদায় নিলাম।
এরপর নিজের হাতে ফাঁসীর দড়ি গলায় পড়েন তাহের। যম টুপি পড়ানোর আগে তাহের বলেন বিদায় বাংলাদেশ, বিদায় দেশবাসী।

No comments:

Post a Comment